শিক্ষাজীবন ও পরিচিতি
তাহমিনা সুলতানা নাশিয়া। পরিচিতজনদের মাঝে নাশিয়া নামেই পরিচিত। নাশিয়া, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সনামধন্য প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্ন, স্বেচ্ছাসেবক ও ফিল্ড রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
শৈশব ও পারিবারিক পরিবেশ
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক বর্ষণমুখর রাতে ভোর ৬টার দিকে জন্মগ্রহণ করেন তাহমিনা সুলতানা নাশিয়া। চট্টগ্রামেই নাশিয়ার জন্ম, চট্টগ্রামেই নানাবাড়িতে অঢেল ভালোবাসা আর আদর যত্নের মাঝে নাশিয়ার বেড়ে উঠা।
মানবিকতা ও সহানুভূতি
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি দরদী মনোভাবসম্পন্ন। প্রতিদিন নিয়ম করে পাড়ার ভিখারি দাদা দাদুরা তার ঘরের দরজায় কড়া নাড়তো। কারণ তারা জানতো প্রতিদিনই নাশিয়া নামের ছোট একটা মেয়ে চাল-ডাল আর কিছু পয়সা-কড়ি নিয়ে তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। একটা মানুষ দরিদ্র হলেই সে সোফায় বসতে পারবেনা, কাঁচের প্লেটে ভাত খেতে পারবেনা, ভালো পোশাক পড়তে পারবেনা, সুচিকিৎসা পাবেনা, মানুষের ভালো ব্যবহার পাবেনা এই বিষয়গুলো তার মনে খুব দাগ টানে। সমাজে বিদ্যমান এই বৈষম্যের বিপরীতেও যে পা বাড়ানো যায় তা নাশিয়া তার পরিবারের কাছেই শিখেছে এবং সেই শিক্ষা তিনি আজও তার মধ্যে বহন করে চলে।
খেলাধুলা ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা
শৈশব থেকেই নাশিয়ার খেলাধুলার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিলো। এমনও হতো যে খেলায় মগ্ন হয়ে সময়ের হদিস হারিয়ে ফেলার কারণে বাড়ি ফিরতে দেরী হওয়াতে একটু আধটু সাজা পেতে হতো। যে বয়সে গাছপালা ছেলে-মেয়েদের খুব একটা আগ্রহের বিষয় হয়না, সেই অল্প বয়সেই তিনি বাগান করার প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। বিভিন্ন জায়গা হতে নাম না জানা বা চিরচেনা চারাগাছ সংগ্রহ করে এনে নিজের বড় একটি বাগান তৈরি করেছিলেন। বলা চলে, প্রাণবন্ত ছোট্ট নাশিয়ার শৈশব শুধু খেলাধুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা, বরং প্রকৃতির প্রতিও ছিলো তার অকৃত্রিম ভালোবাসা।
মেধাবী ছাত্রী নাশিয়া
ছাত্রী হিসেবে তিনি ছিলেন বেশ মেধাবী। স্কুল জীবনে প্রায়শই প্রথম স্থান অর্জন করতেন। তবে তিনি এখনও বিশ্বাস করেন, প্রাতিষ্ঠানিক সফলতাই মানুষের যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি নয়। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বই পড়তে ভালোবাসেন। বিশেষ করে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষামূলক ডক্যুমেন্টারি দেখতে পছন্দ করেন।
প্রার্থনা ও স্বপ্নের শুরু
সন্ধ্যাবেলায় জায়নামাজে বসে যখন তার নানা হাত তুলে দোয়া করতো তখনই ছোট্ট নাশিয়া গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বইপত্র নিয়ে নানার পাশে বসে পড়তেন। তার নানা-নানির স্বপ্ন ছিল তিনি জীবনে কিছু বড় করবেন, মানুষের উপকার করবেন, একজন ডাক্তার হবেন। ছোটবেলায় তিনি কল্পনাপ্রসূত রোগীদের জন্য শতশত প্রেসক্রিপশন লিখতেন। যদিওবা পরবর্তীতে ভাগ্য ভিন্নদিকে মোড় নেয়।
একাকীত্ব ও আধ্যাত্মিকতা
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দূর-দূরান্তে যার বিচরণ ছিলো, নানার মৃত্যুতে হঠাৎ করেই শহুরে জীবনে পদার্পণ তার বিচরণকে সীমিত করে দেয়। শহরে আসার পর প্রচণ্ড একাকীত্বের মাঝে তিনি বুঝতে পারেন যে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই সম্পর্ক তা হলো একজন মানুষ এবং তার সৃষ্টিকর্তার মধ্যকার সম্পর্ক।
সাহায্য ও সমাজে অবদান
হ্যাঁ, ভাগ্যের পরিক্রমায় নাশিয়ার ডাক্তার হওয়া হয়তো হয়ে উঠেনি। তবে পেশাগত লক্ষ্যে এই পরিবর্তন তার মাঝে মানুষকে সাহায্য করার স্পৃহাকে কখনোই দমিয়ে রাখতে পারেনি। পরবর্তীতে, তিনি বিভিন্ন ধরনের অ-লাভজনক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমের সাথে জড়িত হন, যেমন ব্লাডব্যাগ। ব্লাডব্যাগের মাধ্যমে তিনি মানুষকে সহায়তা করার এবং সমাজে অবদান রাখার সুযোগ পেয়েছেন।
জীবনের মূলমন্ত্র
ব্লাডব্যাগের আঞ্চলিক প্রতিনিধি তাহমিনা সুলতানা নাশিয়ার জীবনের মূলমন্ত্র হলো, যতক্ষণ একজন ব্যক্তি ও তার রবের মাঝে সম্পর্ক মজবুত থাকে, এবং যতক্ষণ না ব্যক্তি এমন কিছু করে যা তার সৃষ্টিকর্তার অসন্তুষ্টির কারণ কারণ হচ্ছে ততোক্ষণ কোনো মানুষের অযৌক্তিক মতামত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর গোড়ামিপূর্ণ চিন্তাভাবনা ব্যক্তির লক্ষ্য এবং স্বপ্ন অর্জনের পথে বাধার কারণ হতে দেওয়া যাবে না। কারণ দশজন মানুষ একজন ব্যক্তির সংগ্রামের কথা জানে না, শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি এবং তার সৃষ্টিকর্তাই এই ব্যাপারে জানেন। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের কাছে তার অনুরোধ, কেউ যেনো স্বপ্ন দেখতে কখনো ভয় না পায়। নাশিয়ার ভাষ্যমতে, আমরা পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার আর আসবোনা। এই একবারের সুযোগে আমরা যেনো সদা সর্বদা নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সাহায্য করার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকি। কেননা,
‘আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরে ভাল কিছু দেখেন তাহলে তোমাদের কাছ থেকে যা নেয়া হয়েছে তাত্থেকে উত্তম কিছু তোমাদেরকে তিনি দান করবেন আর তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।’
–আল কুরআন
“যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সহায়তায় থাকে, আল্লাহ তার সহায়তায় থাকেন।” – সহীহ মুসলিম
তাহমিনা সুলতানা নাশিয়া একজন সহানুভূতিশীল, কর্মঠ ও অনুপ্রেরণাদায়ী তরুণী। স্বপ্ন দেখার সীমাহীন আকাশের নিচে, তিনি তার লক্ষ্য অর্জনে এবং মানুষের সেবায় অবিচল থাকবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার জীবনযাত্রা একটি আদর্শ উদাহরণ যা প্রমাণ করে যে, সাহস, সংকল্প এবং নিষ্ঠা দিয়ে একজন ব্যক্তি কীভাবে নিজের এবং সমাজের জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি প্রতিনিয়ত স্রষ্টার উপর ভরসা রেখে নিজ ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে সবার জন্য একটি ভালো পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। নাশিয়া বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তার সাহায্যে সব অসম্ভবকেই সম্ভব করা যায়, এবং তাঁর এই অটল বিশ্বাস ও নিষ্ঠা তাঁকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এগিয়ে নিয়ে যায়। তার নিরলস পরিশ্রম এবং উদ্যম একদিন অবশ্যই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। তাঁর জীবনের গল্প একটি প্রেরণার উৎস, যা অনেককেই অনুপ্রাণিত করবে বড় স্বপ্ন দেখার এবং তা পূরণে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার।