শিরোনাম দেখেই হয়তো অনেকের এক ধরণের কৌতুহল হচ্ছে যে এটি আবার কেমন শিরোনাম ! তবে আজকে এই শিরোনাম দিয়েই একজনের ব্যক্তি জীবনী তুলে ধরবো। এটি শুধুই একটি নিছক জীবন গল্প নয় বরং এটি একটি প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে ফেরা একটি জীবন গল্প!
বাংলাদেশের একবারে উত্তরের জেলা দিনাজপুরে তামীমা মেয়েটির জন্ম । উত্তরের হাঁড় কাঁপানো কন কনে শীতের সময়ে জন্মই মেয়েটির জীবনের সূচনা বিন্দু। এই মেয়েটির জীবনেরই বহুবার নানা ঘটনায় উঠে আসা “ কবে” শব্দটির চিন্তা “কেন” শব্দতে পরিবর্তিত হওয়ার গল্পটিই আপনাদের মাঝে তুলে ধরবো।
জন্মের পর পরই বাবা মায়ের চাকরি সূত্রে গাজীপুরে চলে যেতে হয়। যার ফলে কিছু দিন পরপরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেতে হতো তাদের। তবে প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল গাজীপুর এই। মা কলেজের শিক্ষকতা করতো যার ফলে সব সময়ই দেখতো মা পড়াশোনা করছে কিংবা পড়াচ্ছে। সেই থেকেই হয়তো তামীমার কোনও জিনিস পড়ে শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়ে যায় । ছোট থেকেই ভীষণ রকমের শান্ত এবং ভীরু ধরনের মেয়ে ছিল। এতটাই কম কথা বলতো যে অনেকে বোবা বলতেও দ্বিধা বোধ করতো না। সবার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে মেশার বিষয়টা ছোটবেলা থেকে ধারণার বাহিরে ছিল।
তবে চার বছর বয়সে থাকাকালীন সময়ে গাজীপুরে একটি গানের স্কুলে ভর্তি হয়। এই র্ক্লাসের মধ্যে দিয়ে সবার সাথে স্বাচ্ছন্দে মেশার বিষয়টি সহজ হয়ে যেতে শুরু করে। ছোট থেকেই বিভিন্ন কালচারাল বিষয়গুলো শিখতে শুরু করে। তবে কোন এক পর্যায়ে সেলফ রিলাইজেশন তৈরি হয় ধর্মের প্রতি। ততদিনে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থাকা শেষ।
বারবার জেলা পরিবর্তনের ফলে দেশের বিভিন্ন স্কুলে পড়া হয়েছে । এক জায়গার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না নিতে আরেক জায়গায় চলে যেতে হয় তাকে! তবে কারো সাথে খুব একটা মেলামেশা করতে পারতো না । এই না পারার জন্য সারাদিন চার দেয়ালের ভেতরেই বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে। কিংবা ইনডোর গেমস খেলে কিংবা সিডি দেখেই দিন চলে যেত। এভাবেই চলছিল জীবন । সবসময় ভাবতো “কবে” মনের মত একটা জীবন হবে!
অষ্টম শ্রেণীর আগে পর্যন্ত সে জীবন বলতে শুধু জানতো পড়তে হবে,খেলতে হবে,নামাজ পড়তে হবে,বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার নিয়ে সেগুলো স্কুলে জমা দিতে হবে। তবে ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন জিনিস কিভাবে তৈরি হয় সেই প্রসেস গুলো জানতো খুবই আগ্রহী ছিল। সেই সব কিছু চিন্তা ধারা থেকেই অষ্টম শ্রেণী থেকে টেকনোলজি কিংবা বিজ্ঞান নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চিন্তা ভাবনা করা কিংবা লেখালেখি করার যাত্রা শুরু হয় তার।
অষ্টম শ্রেণির শেষের দিকে স্কুলের এক ম্যাডাম তাকে বলেছিল বিজ্ঞান মেলায় প্রজেক্ট উপস্থাপন করার জন্য। কিন্তু যেই মেয়ে সারা জীবন লেখালেখি ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলো দিয়ে এসেছে। সেই মেয়ে কিভাবে সাইন্স ফেয়ারে এত মানুষের সামনে কথা বলবে। যেখানে সে ঠিক মত কথাই বলতে পারেনা!! আমি ঠিক সেই সময়ের কথা বলছি যখন পুরো বিশ্ব করোনা মহামারী কাটিয়ে সবেমাত্র স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে ! তবে যাই হোক তিন দিনের মেলায় প্রথম দিন কোন মতে আ হু করেই পার করে দিয়েছিল! প্রথম দিনের রেজাল্টে দেখা গেল সে প্রথম হয়ে গেছে! সেই থেকে সে বুঝতে পেরেছিল যে সে কম কথা বলেও যতটুকু বলছে ততটুকু হয়তো বা কোন কাজের কথা বলছে! “কবে” যে সেই চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করবে। সেটাই চিন্তা করতে করতে বোবা ধরনের মেয়েটি পরপর বিভিন্ন ধরনের ফেয়ার ,বক্তৃতা মূলক প্রতিযোগিতা কিংবা উপস্থাপনা কোনটাই আর বাদ গেল না অংশগ্রহণ নেওয়া থেকে।
এরপরে সে এক অদ্ভুত জগতে যাত্রা শুরু করেছিল যে জগত সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র চিন্তা ধারা ছিল না,তা হলো অর্গানাইজেশনের জগৎ! নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন সময়ে প্রথম একটি ফেসবুক আইডি খুলে ছিল সে । সেই সূত্র ধরেই একটি প্রতিষ্ঠানে উপস্থাপনা করার ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে এই যাত্রা সূচনা হয়। ভাবতো “কবে” যে এই ফিল্ডের বিষয়গুলোতে সে দক্ষ হয়ে যাবে !ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের স্কিল ডেভলপ করা কিংবা লিডারশিপ এর জায়গাটাতেও সে ভালো দক্ষতা অর্জন করে!
এভাবে ই চলছিল তার জীবন । তবে দশম শ্রেণীতে থাকাকালীন সময়ে হঠাৎ করেই স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পরে বুঝতে পারছিল তার কোন কিছুই মনে থাকছে না। কিংবা সে কোন বিষয় নিয়েই চিন্তা করতে পারছে না!! এই অদ্ভুত কথাগুলো তার পরিবার যখন জানতে পারলো তখন তারা ধরে নিয়েছিল যে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে! চিকিৎসা করার জন্য প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একজন নিউরোলজিস্ট এর কাছে ।
সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে ডাক্তার বড় বড় করে প্রেসক্রিপশন এর উপর লিখে দিয়েছিল “ফ্রিজোফ্রেনিয়ার রোগী” ।
এই ছয় অক্ষরের ভয়ানক শব্দ দেখার পর মুহূর্তের মধ্যে তার জীবনের সকল স্বপ্ন,আশা,চিন্তাধারা মুছে গেল ! ডাক্তারের ওষুধ চার দিন খাওয়ার পরেই দেখা গেল ভিন্ন এক চিত্র !
হঠাৎ একদিন সকাল থেকে পরিবারের মানুষজন খেয়াল করল কোন ভাবেই সে আর চোখ খুলছে না! এভাবেই চলে গেল টানা ১৮ টি দিন ! যখনই চোখ খুলে তখনই দেখে সামনে পুরো পৃথিবী অন্ধকার! নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।সেখানে কোন রঙের অস্তিত্ব নেই কোন কিছু অনুভব করার অস্তিত্ব নেই কিছু নেই!! সারাদিন মাথায় একটা শব্দই ঘুরতে তার “কবে,কবে,কবে”! কবে সে আবার আগের মতো হয়ে যাবে?
ততদিনে পড়াশুনো কিংবা পৃথিবীর অন্য কোন কাজকর্মই সে বিন্দুমাত্র করেনি। শুধুমাত্র পছন্দের লেখালেখি এবং আঁকাআকি ছাড়া!
তামীমার পরিবার এটি মেনে নিতে পারছিল না । একজন সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে ধীরে ধীরে কিভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে!
এভাবেই চলল টানা দুই মাস এই রোগের চিকিৎসা। ততদিনে এইসব ওষুধ পত্রের রিঅ্যাকশনে শরীরের বিভিন্ন অংশে ইনফেকশন হওয়া শুরু করে! কোন ধরনের উপায় না পেয়ে আবার দেখানো হলো মেডিসিন ডক্টর। মানসিক টেনশন,শরীর দুর্বলতা সবকিছু নিয়েই ভীষণ রকমের এক বাজে জীবন কাটাচ্ছিল। ভাবতো এই ভীষণ কষ্টের দিনগুলো “কবে” তার সুদিনে পরিণত হবে?
এই সময়ে কতবার যে নিজেকে শেষ করে দেওয়া চিন্তা ভাবনা মাথায় এনেছিল হয়তোবা সেই সময় সৃষ্টিকর্তা ছাড়া অন্য কেউ জানতো না!
সামনে ছিল তার এসএসসি পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষা। সে ধরে নিয়েছিল তার জীবনে পড়ালেখা বলতে আর
কোন শব্দই নেই কারণ যে কোন কিছু মনেই রাখতে পারে না সে কীভাবে পড়বে! তবুও সে পড়তে বসতো। কি সব পড়তো কি সব লিখতো নিজেও বুঝতো না। বাসায় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এ বছর পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই ।আগামী বছর পরে যদি সে সুস্থ হয় তবেই সে পরীক্ষা দিবে!! দিন যতই যায় শরীর কিংবা মানসিক অবস্থা ততই আরও খারাপ হয়!
হসপিটাল থেকে বাসা আবার বাসায় থেকে হসপিটাল এইসব ঘুরে ঘুরে চলে যাচ্ছিল দিন! হসপিটালের বেডে শুয়ে হসপিটালের সিলিং এ দিয়ে তাকিয়ে থাকা, আর মুখে মুখে অংকের বিভিন্ন সূত্র মনে করে সেগুলোতে ভ্যেলু বসিয়ে অংক করা ছিল তার সবথেকে পছন্দের কাজের মধ্যে একটা! পাখাটা বামপাশে কত কোণে কতবার ঘুরলো কিংবা ডান পাশে কত কোণে কতবার ঘুরলো ,স্যালাইনের প্রতি ফোঁটা গোণা এসব কিছু হিসাব করতে করতেই দেখতো রাত শেষ হয়ে গেছে!! রাত শেষে দিন চলে আসলেও “কবে” শব্দটার উত্তর আসছিল না আর।
শেষমেষ সে বুঝতে পারছিল পরিস্থিতি বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে! তারপর সে সিদ্ধান্ত নিল অন্য কোন রোগের ওষুধ খাওয়ার আর প্রয়োজন নেই!
এটিই ছিল তামীমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া একটি বড় সিদ্ধান্ত। কিংবা সেলফ রিয়েলাইজেশনও বলা যায়! সুস্থ হয়ে ওঠা শুরু করল, পড়াশোনা শুরু করল,মানসিক সমস্যা তৈরি হয় এমন সকল ধরনের ঘটনা থেকেই দূরে আসা শুরু করল!
জীবনের এই পর্যায়ে এসে আগের সব কিছুই স্বাভাবিক হলো শুধু আগের মতো সেই কথা বলা, সবার সাথে মেশা এই সবকিছু থেকে দূরে সরে আসল! চাইলেও আর আগের মতো হতে পারে না ।
এত রহস্যময়ী একটা মেয়ে হয়ে গেল যে তাকে এখন খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর ব্যাপার!! জীবনের সবকিছুই এখন জীবনের নিয়মে চলছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে “কবে” শব্দের পাশাপাশি নতুন আরেকটি শব্দ যুক্ত হল “কেন” । “কেন” তার জীবনের গল্পে “কবে” শব্দটির পরিবর্তে জীবনে এত কিছু ঘটে গেল !?
নাকি সৃষ্টিকর্তাই চেয়েছিল তার জীবনটা “কবে” শব্দটি পরিবর্তন করে “কেন” শব্দটি বসিয়ে জীবনকে আরো নতুন ছন্দময় জীবনে পরিণত করা!
রয়ে গেছে তার হাজার অব্যক্ত কথা , প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে যাওয়া হাজার কিছু ঘটনা তবে “কবে থেকে কেন” এই ছন্দময় জীবনে তার জীবন এখন শুধুই রহস্যময় !